সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ব্যবসায় পুঁজি ব্যবস্থাপনা নানান দিক


ব্যবসা করতে হলে প্রথমে নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হয়। তারপর, টার্গেট মার্কেট এনালাইজ/ যাচাই করতে হয়। টাকা থাকলেই ব্যবসা হয় না বা ব্যবসা করা যায় না। ব্যবসার জগতটা অনেক জটিল; মেধা-প্রজ্ঞা দ্বারা প্রযুক্তির সহায়তায় সহজ করে নিতে হয়। ব্যবসার জগতে সফল মানুষের চেয়ে, ব্যর্থ মানুষের সংখ্যাই বেশি। কারণ, বেশির ভাগ মানুষ ব্যবসার শুরুতেই টাকা নিয়ে ভাবে। মাঝখান দিয়ে পুঁজির টাকা কোনটা কোন দিকে যায়, তার আর হিসাব থাকে না। গ্রস মার্জিন টেনে লভ্যাংশ আর বিনিয়োগকৃত মূলধন কোনটা কি তা আর বুঝতে পারে না; টার্নওভারের কথা দূরে থাক। দিনশেষে দেউলিয়া হয়ে যায়।

অনেক আগে ব্যবসার জগতে মাড়োয়ারদের মধ্যে একটা কথা খুবই প্রচলিত ছিল। দেড়-টাকা, পাঁচ-সিকির ব্যবসা বলে। একবার এক লোক এক টাকা দিয়ে কিছু পণ্য কিনলো। কিনে সে পাঁচ সিকি (মানে এক টাকা পঁচিশ পয়সা) বিক্রি করলো। তার মানে তার পঁচিশ পয়সা লাভ হলো। কিন্তু, দিনশেষে দেখা গেলো লাভের টাকা তার হাতে নেই। কোথায় গেলো, কোথায় গেলো! মহা মুশকিল! হিসাব করে দেখা গেলো, পণ্য পরিবহনে পঁচিশ পয়সা লেগেছিল, সেটা ধরে সে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করেনি। ক্রয়কৃত দামের উপর পণ্যমূল্য নির্ধারণ করে। যার ফলে সে ক্ষতির সম্মূখীন হয়। এজন্য পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজের কোয়ালিটি বাড়ানোর পাশাপাশি পণ্যমান বাড়ানো ও মূল্য নির্ধারণ করা শিখতে হয়। তাই বলে পণ্যমূল্য এমনভাবে আবার নির্ধারণ করা যাবে না, যেটা অযৌক্তিক মুনাফার লালসায় পরিণত করে। দুদিন পরেই ব্যবসা গুটানো লাগবে। দেশের বাজারে মুদ্রাস্ফিতির হার হিসাব করে ৯-১২ শতাংশ মুনাফা করলেই যথেষ্ট বলে আমার মনে হয়। এর বেশি হলে আমার কাছে অযৌক্তিক মনে হয়। কারণ, ন্যায্যমূল্যের অতিরিক্ত মূল্যে ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতা লোপ পায়। বাজার ব্যবস্থার উপর চাপ তৈরি হয়। ন্যায্যমূল্যের অতিরিক্ত ধার্যকৃত মূল্যের কারণে বাজার ব্যবস্থায় যে চাপ তৈরি হয় তাতে করে মুদ্রাস্ফিতি বেড়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। এ কারণে আপনি এটা করলে নিজের, দেশ ও দশের, সবারই ক্ষতি হয়।

ছোট্ট একটা উদাহরণ দিচ্ছি। আমরা যারা ৯০ এর দশকের একেবারে শুরুতেই জন্মেছি, তারা সবাই মোটামুটি এরোমেটিক ১০০ ভাগ হালাল সাবানের কথা জানি। একটা কথা দিয়েই রূপচর্চায় মাটি মাখা মানুষদের সাবান ব্যবহারে উদ্ধুদ্ধ করতে পেরেছিল এরোমেটিক। সে সময়ে বাংলাদেশের বাজারে সাবানের মোটা দাগের বৈশ্বিক ব্রাণ্ড লাক্সের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল এই এরোমেটিক। কিন্তু, সময়ের সাথে সাথে কোয়ালিটি পণ্য দিতে না পারায়, যতই হালাল হোক পুরো এরোমেটিক সাবানের ব্রাণ্ডটিই বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে। লাক্স লাক্সই রয়ে গেছে। মুনাফা করতে এসে কোয়ালিটি পণ্য না দিতে পারলে আপনি সহজেই বাজার হিস্যা হারাবেন। এতে কোন সন্দেহ নেই। ন্যাড়া বারবার বেলতলায় গেলেও, বেলগাছও একদিন জৌলুস হারিয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। দাড় করানোর পর জৌলুস ধরে রাখাটাই আসল কাজ।

একজন বেপারি আর একজন ব্যবসায়ীর মূল পার্থক্য এই মেধা-প্রজ্ঞা দ্বারা নির্ধারিত হয়। বেপারি বলতে বুঝি খুচরা পণ্য বিক্রেতা। তবে, বর্তমানের চেইনশপগুলোকে এর সাথে মিশিয়ে গুলিয়ে ফেলবেন না। কারণ, তারা চেইনশপ। ছোটখাটো দোকান না। ব্যবসায়ী বলতে বুঝি যারা বৃহত্তর পরিসরে নিজেদের তৈরি করেন।

যাহোক, গত সপ্তাহে আলোচনা করেছিলাম ব্যবসা করতে হলে কি কি দরকার সে বিষয়ে। এ সপ্তাহে আলোচনা করবো পুঁজি ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার সার্বিক দিক নিয়ে। পুঁজির সংস্থান করলেন, কিন্তু পুঁজির ব্যবস্থাপনা জানেন না, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় অজ্ঞ, হবে না, আপনারে দিয়ে ব্যবসা হবে না। সব কিছুতে নির্ভরশীল হলে দেউলিয়া হতে সময় লাগে না। এখন এগুলো শেখার জন্য আপনাকে কারো কাছে ধর্ণা দেয়া লাগবে না। বই পড়ে, গুগল করে, ইউটিউব ঘেটে খুব সহজেই কার্যকরী ও প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই শিখতে পারবেন। শুধু সদিচ্ছা আর ধৈর্য্য লাগবে।

আসুন দেখি পুঁজির ব্যবস্থাপনায় কি কি করা যায়।

১. পই পই করে হিসাব রাখতে হবেঃ একজন বিজনেস মন্সটার মূলত ম্যানেজারদের সর্দার ছাড়া কিছুই না। তারা সবার কাজের হিসাব রাখেন, সংখ্যা আর সময় দিয়ে। এখন কথা হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীগণ কি করবেন। তারা মূলত বসে বসে কোন টাকা কোথায় যাচ্ছে, কোথা থেকে কিভাবে আসছে, এগুলোর হিসাব রাখবেন। ব্যয় ব্যবস্থাপনার জন্য এক হিসাব, আবার আয় ব্যবস্থাপনার এক হিসাব, আর সার্বিক হিসাব তো রাখতেই হবে। মধ্যস্বত্বভোগী, কর্মী বাহিনীর কর্মঘন্টার হিসাব, তাদের দেনা-পাওনার হিসাবগুলো যাবে ব্যয় ব্যবস্থাপনার খাতে।

২. ব্যাংকিংঃ এটা পুঁজি ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক। এটা নিয়ে অন্য একটি লেখায় আলোচনা করেছি। নিচে লিঙ্কটা দিয়ে দিলাম।


২. নগদ সরবরাহ ধরে রাখাঃ ব্রিটিশ মধু বিক্রেতার কথা নিশ্চয়ই পড়েছেন। নগদ সরবরাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেখা যাচ্ছে আপনি নগদে পণ্য ক্রয় করে বাকিতে বিক্রি করেন। আপনার পুঁজি দীর্ঘদিন আটকে থাকে। একটা সময় দেখা যাবে বিনিয়োগকৃত টাকা সব বাজারে বসে গেছে। হাতে টাকা নেই। নতুন পণ্যও আপনার হাতে নেই। কারণ, নগদে পণ্য বা কাঁচামাল কেনার জন্য আপনার হাতে টাকা নেই। সুতরাং, ব্যবসাও নেই। স্থানীয় বাজার ব্যবস্থায় বহু লোক এভাবে নগদ সরবরাহ হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে গেছে। সুতরাং, সাবধান হতে হবে।

৩. পূনর্বিনিয়োগঃ ইংরেজিতে বলে রি-ইনভেস্টমেন্ট। আপনার বিনিয়োগকৃত টাকা যত ঘোরাবেন ততই আপনার পুনঃপুন লাভ হবে। মানে যতবার আপনি একই টাকায় পণ্য কিনে বা তৈরি করে বাজারে চাহিদানুপাতে ছাড়বেন ততই আপনার লাভ হবে। তবে, অনেক ফটকাবাজ আছে যারা কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করে বাজার-হিস্যা ধরার চেষ্টা করে। এটা নিতান্তই বোকামী। চুরি করে বেশিদিন বাজারে টিকে থাকা যায় না।

৪. পুঁজির জোগান বাড়ানোঃ ধীরে ধীরে আপনাকে লভ্যাংশ থেকে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আপনার সামনে সবাই দৌড়াচ্ছে, আপনি যেখানে আছেন, সেখানেই পড়ে থাকলে, যোজন যোজন পিছিয়ে পড়বেন। একটা সময় সামনের লোকগুলো অনেকদূর চলে যাবে। আপনি ধোয়াশায় কিছুই দেখতে পাবেন না। হারিয়ে যাবেন।

৫. রিসাইক্লিংঃ এটাকে সহজ করে বললে, অকেজো জিনিসকে ব্যবহারযোগ্য করে খরচ কমানো। তাহলে, আপনার পুঁজি সংকটের চাপ কমে যাবে।

৬. অটোমেশনে শ্রমনির্ভরতা কমানোঃ কথাটা বলা কষ্টকর। এমনকি বলাটাও ঠিক না। বহু মানুষ অদক্ষ শ্রমিকে পরিণত হবে। তবে, প্রতিযোগিতার বাজারে আপনাকে এটা বাধ্য হয়ে করতেই হবে। আমাদের দেশের মানুষ কম দামে বেশি পণ্য কেনায় আগ্রহী। এ কারণে, বৈশ্বিক বাজারেও আমাদেরকে ওভাবেই যায়গা করে নিতে হয়েছে। বিদেশী ক্রেতাগণও কম দামে বেশি পণ্য কেনার জন্য এদেশেই আগমণ করেন। এ কারণে, কম দামে বেশি পণ্য তৈরিতে শ্রম নির্ভরতা কমাতে বাধ্য হচ্ছেন বড় বড় ব্যবসায়ীগণ। জাতীয়ভাবে চিন্তা-ভাবনায় পরিবর্তন দরকার। সব ধরনের পণ্য ব্যবহারের মানসিকতা সম্পন্ন না হলে, বৈশ্বিক বাজারে নিজেদের হিস্যা ধরে রাখা মুশকিল হবে। পাবলিক পারচেজিং প্যারিটি আমাদের বেড়েছে। তাহলে, বদ্ধমূল ধারনার কেন পরিবর্তন করবেন না। করতেই হবে।

৭. ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাঃ আর্থিক ঝুকি কমাতে আপনাকে বীমার আওতাভুক্ত হতে হবে। বীমা আর আমানত এক জিনিস না। আমাদের দেশের বীমা কোম্পানিগুলো উচ্চমুনাফায় আমানত গ্রহণ করে থাকে। যতটুকু জানি, যেটা দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কতৃক একেবারেই নিষিদ্ধ। গতকয়েকদিন আগেও এটা নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল। আমার জানামতে, সরকার অনুমোদিত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যতিত গ্রাহকের নিকট থেকে আমানত গ্রহণ করার এখতিয়ার আর কারোরই নেই। আগে আপনাকে বুঝতে হবে বীমা কি? কেন আপনি বীমা করবেন? কোন কোন বিষয়ে বীমা করা যায়। সার্বিক বিষয় সম্বন্ধে জানতে হবে।

পুঁজি ব্যবস্থাপনা আর্থিক ব্যবস্থাপনারই অনুষঙ্গ। ব্যবসায় আর্থিক ব্যবস্থাপনার জন্য আপনাকে টাকার ব্যবহারিক দিক সম্পর্কে জানতে হবে। টাকার চাকা কিভাবে ঘোরে সে সম্বন্ধে জানতে হবে। কোথায় গেলে বাড়ে, কোথায় গেলে কমে। মুদ্রাস্ফিতির হার কখন কত। কত হলে কিভাবে পণ্যমূল্য নির্ধারণ করলে সেটা যৌক্তিক হবে। এক এক পণ্যের ধরণ যেমন আলাদা আলাদা, তেমনি চাহিদার মাত্রাও আলাদা আলাদা। কতটুকু উৎপাদন বা আমদানী করলে যোগান-চাহিদার অনুপাত ঠিক থাকবে, তা যাচাই করা। বিশেষ করে পঁচনশীল পণ্যে চাহিদার অতিরিক্ত উৎপাদন বা আমদানী করলে তাতে সরাসরি লস খেতে হয়। তাছাড়া, প্রতিযোগিতার বাজারে অন্যান্য প্রতিযোগীগণও মুখিয়ে থাকেন, কখন একজন প্রতিযোগীকে মাঠ থেকে হঠিয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করা যায়। সুতরাং, সব সময় আর্থিক পরিকল্পনা থাকতে হবে।